ঋ ষি ক দা শ গু প্ত - ১০ বছর
সুইডেন
ঠিক করেছি বিজ্ঞান নিয়ে লিখবো। কিন্তু, তোমরা যারা আমাকে চেনো, তারা জানো (আর যারা চেনো না, তারাও জেনে গেলে) যে, আমি খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারটা খুব ভালোবাসি। তাই আমার বিজ্ঞানের কথায় খাবারের কথাও থাকবে।
আমার আজকের বিষয় - ক্যারামেলাইজেশন।
ক্যারামেল আমার খুব পছন্দের (আমার বাবারও ফেভারিট)। ক্যারামেল আইসক্রিম, ক্যারামেল ফাজ, ক্যারামেল কাস্টার্ড, পুডিং, কেক, মিল্কশেক, কফি - তোমরাও নিশ্চয়ই খুব পছন্দ করো!
এসো, আজ আমরা একটু ক্যারামেলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিই।
ক্যারামেল কি?
ক্যারামেল একটি কমলা-বাদামী আঠালো তরল মিষ্টি খাবার, যা চিনি পুড়িয়ে তৈরী হয়। বিভিন্ন রকম ডেসার্টের উপাদান বা টপিং হিসাবে ক্যারামেল খুবই জনপ্রিয়।
ক্যারামেলের ইতিহাস
ক্যারামেল শব্দটি সম্ভবত পর্তুগিজ শব্দ caramelo থেকে এসেছে। মনে করা হয় ক্যারামেলের সবচেয়ে পুরোনো সংস্করণ আরব-রা প্রথম ১০০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরী করে। সেই সময় তারা চিনি এবং জল মিশিয়ে এক রকমের তরল তৈরি করেছিল যা মূলতঃ সাজগোজের কাজে ব্যবহার করা হতো। পরে এটা একটা মিষ্টি খাবার হিসাবে পরিচিত হয়। আরবিক শব্দ "kora-moħalláh" বা মিষ্টির বল সম্ভবতঃ ক্যারামেলকেই বলা হতো।
অনেক পরে ১৯৭৭ সালে এক ফরাসী শেফ বাদামের কুচি আর মাখন দিয়ে নোনতা ক্যারামেল তৈরী করেন। ক্রমশ ফ্রান্সে আর বিভিন্ন ফরাসি-ভাষী ইউরোপীয় দেশে সল্টেড ক্যারামেল খুব জনপ্রিয়তা পায়। বছর কুড়ির মধ্যেই ক্যারামেলের ব্যবহার সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। Haagen-Dazs আর Starbucks এর মতো বড় দোকানগুলো ক্যারামেল দেওয়া খাবার ও পানীয় বিক্রি করতে শুরু করে।
ক্যারামেলাইজেশন কি ভাবে হয়?
ক্যারামেলাইজেশন হল একটি ধীর রান্নার প্রক্রিয়া (slow cooking process)। চিনিকে গরম করতে করতে চিনির অণুগুলো বাতাসে অক্সিজেনের সঙ্গে এবং একে অন্যের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ক্যারামেল তৈরী করে। ক্যারামেল তৈরির এই পদ্ধতিকেই ক্যারামেলইজেশন বলা হয়।
যে কোনও চিনি ক্যারামেলাইজড হতে পারে এবং ক্যারামেলাইজেশনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা চিনির রাসায়নিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে। যে তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরণের চিনি ক্যারামেলাইজড হতে শুরু করে তা হল:
সুক্রোজ: 320° ফারেনহাইট
ফ্রুক্টোজ: 230° ফারেনহাইট
গ্লুকোজ: 320° ফারেনহাইট
গ্যালাকটোজ: 320° ফারেনহাইট
ল্যাকটোজ: 397° ফারেনহাইট
সুক্রোজ (অর্থাৎ টেবিল চিনি) হলো সবচেয়ে সাধারণ চিনি যা ক্যারামেল তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসাবে আমরা সুক্রোজ ক্যারামেলাইজেশন পদ্ধতি একটু বিশদে আলোচনা করতে পারি।
সুক্রোজের ক্যারামেলাইজেশন শুরু হয় যখন চিনি বেশি তাপমাত্রায় গলে যেতে শুরু করে এবং তারপরে তা ফুটন্ত (foaming ) অবস্থায় পৌঁছায়। এইসময় সুক্রোজ প্রথমে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজে ভেঙে যায়। তারপরে ঘনীভবন পর্যায় আরম্ভ হয় যেখানে চিনির অণুগুলো থেকে জল বেরিয়ে যেতে শুরু করে এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। এই সময় অণুগুলি হয় ছোট অণুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বা একে অপরের সঙ্গে মিশে আরও বড় অণু তৈরি করে। ফলে বিভিন্ন জটিল স্বাদ ও সুগন্ধের কয়েকশো নতুন যৌগ তৈরী হতে থাকে ।
সুক্রোজের ক্যারামেলাইজেশনে যে প্রধান তিনটি যৌগ তৈরী হয় তারা হলো –
ক) ক্যারামেলান (caramelan) – C12H12O9,
খ) ক্যারামেলেন (caramelen) - C24H26O13 এবং
গ) ক্যারামেলিন (caramelin ) – C36H18O24।
এর সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরণের সুগন্ধি যৌগ যেমন ফুরান (furan), মলটোল (maltol), ইথাইল এসিটেট (ethyl acetate) বা ডায়াসেটিল (diacetyl).
এই সমস্ত যৌগ এক সঙ্গে মিশে এক জটিল বাদামী রঙের মিশ্রণের চেহারা নেয় । একেই আমরা ক্যারামেল বলি। ।
ক্যারামেল কোথায় কোথায় ব্যবহার করা হয়?
ক্যারামেল অনেক খাবারে থাকে যেমন - ক্যারামেল কাস্টার্ড, ক্রিম ব্রুলি, ক্যারামেল আপেল (ক্যারামেল আর চকলেট-এ ডোবানো আপেল), ক্যারামেল পপকর্ন, ডোডোল (এক রকমের মিষ্টি যেখানে ক্যারামেল আর নারকেল দুধ থাকে), ক্যারামেলাইজেড দুধ, টফি (ক্যারামেল লজেন্স), ক্যারামেল ফাজ , সল্টেড ক্যারামেল আইসক্রিম, ক্যারামেল কেক, ক্যারামেল স্বাদের চকলেট, ক্যারামেল মাচ্চিয়াটো (কফি) এমন কি কোকাকোলার মতো ঠান্ডা পানীয়তেও।
উপরের বাঁ -দিক থেকে: ১. ক্যারামেল মাচ্চিয়াটো ২. ক্যারামেল সস ৩. ক্যারামেল আপেল ৪. গোয়ার ডোডোল
ক্যারামেল খাওয়া কি ভালো?
ক্যারামেল তৈরী করতে ব্যবহার করা অপরিশোধিত শর্করায় অল্প পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ থাকতে পারে। রক্ত তৈরির জন্য আয়রন গুরুত্বপূর্ণ, সুস্থ হাড়ের জন্য ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ এবং হৃদপিণ্ড ও স্নায়ুর ঠিকমতো কাজ করার জন্য পটাসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, ক্যারামেল খাওয়ার পরে, শরীর শর্করাকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করে, যা পরে রক্তে মিশে যায় এবং কোষে শক্তি যোগায়।
যদিও তাড়াতাড়ি শরীরে শক্তি বাড়াতে ক্যারামেল সাহায্য করে, কিন্তু এর ফল বেশিক্ষণ থাকে না, কারণ ক্যারামেলে থাকা শর্করা খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়।
ক্যারামেল খাওয়ার কিছু বিপদও আছে। ক্যারামেল চিনি থেকে তৈরি হয়, যা ওজন বাড়ায়, দাঁতের ক্ষয় এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও বেশি খাওয়া হয়ে গেলে ক্যারামেল শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালোরি যোগ করতে পারে - যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
শেষ কথা
তাহলে আর কি? এতো দিন তোমরা শুধু ক্যারামেল খেতে ভালোবাসতে, এখন ক্যারামেলের ভেতরের খবরও সব জেনে গেলে। পরের "ডেসার্ট-ডে" তে ক্যারামেল আইসক্রিম কিংবা পুডিং খাওয়ার প্ল্যান বানিয়ে ফেলো এবার। কিন্তু অন্য পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে অল্প করে খেও যাতে শরীরের ক্ষতি না হয় - ঠিক আছে?