top of page
Writer's pictureSambandh

ছকভাঙা

Updated: Oct 12

(অন্তিম পর্ব)


নি রু প ম দা স

অ ঞ্জ না দা স 

সুইডেন


 

কি যে মুশকিল, সারাদিন বৃষ্টি আর তার সাথে লোড-শেডিং। কবিদের হয়তো কবিতা পায়, ব্যাঙেদের গান, বরুনের বিরক্তি পায়। 


তবে সুদীপ্তার পছন্দের ।  ওর তো হবেই।  জানলার ধারে বসে, হাতে গরম চা আর স্যান্ডউইচ পেয়ে যায়।  আর ভাবে, কি মজা হতো যদি উপল গিটার  বাজিয়ে গাইতো সামনে বসে  "তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই.."


একটা বিরক্তি আর ভালোবাসা  মেশানো আওয়াজ বেরিয়ে আসলো বরুনের। ৫ মাস ২১ দিন হয়ে গেল কথা হয়নি।  ৬ মাস এর ডিল ছিল , কেউ কাউকে ফোন করবে না  , দেখা  করবে না।

 

নিজের মাথায় গাট্টা দিতে ইচ্ছে করে বরুনের।  সেই তো বলেছিলো, পাকা ছেলে একটা । 

 

"সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।..." - FM টাও মজা নিচ্ছে। 

 

একদিন আর থাকতে না পেরে, ওদের বুটিকের সামনের গলি তে কিছুক্ষন  দাঁড়িয়ে ছিল।  একটু দূর থেকে দেখেছিলো সেদিন ওকে।  আগের থেকে শান্ত, আগের থেকে উজ্জল , আগের থেকেও  সুন্দর। কিন্তু শরীর টা একটু খারাপ ঠাহর হলো  ?

 

চিন্তায় ছেদ পড়লো। ভাটুদার বাজখাই গলা।  উঁকি মারে বরুন।  ঠিক ধরেছে। 

 

ছেলের টাকা আছে, কিন্তু টেস্ট নেই।  চেক প্যান্ট, আর্জেন্টিনার টি-শার্ট , আর একটা হলুদ সানগ্লাস।  ঝুম্পা বিড়ির প্যাকেট উঁকি পারে পকেট থেকে।  ক্লাসিক ভাটুদা।

 

ঘরে ঢুকে পরে ১১৩ কেজির প্রাণীটা।  মোটা মানুষগুলির একটা খুব কমন ট্রেইট হলো , বেশ মজাদার আর নির্ভেজাল টাইপ। 

 

"কবে খাওয়াবি বল , আর সিঙ্গেল মল্ট চাই এবার।  ওল্ড মঙ্কে আর  ভবি  ভুলবে না। "

 

"পেয়ে গেছি !!" - বরুনের উচ্ছসিত গলা

 

"শোন , নেভার আন্ডার এস্টিমেট দা পাওয়ার অফ বকাটে পাবলিক " - ২২ পাটি বের করে ভাটু।

 

বরুন ঝাঁপ দায় , ভাটুদার কোলে। 

 

বরুনের প্রায় চোখে জল।  তারপর গায়ের দুর্ঘন্ধে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে-

"সিঙ্গেল মল্ট এর আগে তোমায় আমি একটা রুম ফ্রেশনার গিফট করবো।"

 

"হা রে...ছেলে , প্রেম, বিয়ে সব তুই করবি, তার জন্যে খেটে  মরছি আমি , আর তুই উক্তি দিচ্ছিস  ? নেমকহারাম" - ভাটু চিল্লায়, বরুনের পিঠে কিল বসাতে যায়। 

 

"অরে অমনি করো না , তুমি হলে আমার জয় , খানিক ভারী অমিতাভ আর আমি হলাম তোমার বিরু। " - কিল খেয়েও হাসে বরুন।

 

"তা, বসন্তীর কি খবর ? সে কি ফ্রেঞ্চ খাবার বানানো প্র্যাক্টিস করছে , না এখনো মাছ ভাতেই ভরসা ?" -  ভাটুর ২২ পাটি আবার।

 

সুদীপ্তার মুখটা ভেসে ওঠে।  বিশ্বাস করতে চায় অনেক কিছু ।  বরুনের বাইকের পিছন সিটটা যে তার জন্যেই।  কিন্তু খবরের আদান প্রদান যে বন্ধ, কি হয়ে বসে আছে এতদিনে কে জানে ? হয়তো ডেস্টিনেশ ওয়েডিংয়ের  প্ল্যান সব পাকা। হয়তো ভিসা চলে এসেছে। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে।

 

"কি রে , বেদনার বালুচর হয়ে গেলি যে ? " - ভাটুর হাসিটা একটু ম্লান।

 

নিজেকে একটু সামলে নেয় বরুন।  বলে "ভাটুদা সিঙ্গেল মল্ট হবেই , তোমার নাম টা একটু ঠিকঠাক  হলে , আমার ছেলের নাম তোমার নামেই  রাখতাম। তোমার নীল -সাদা হাওয়াই চপ্পলের দিব্বি। "

 

 

বৃষ্টিটা আজ যেন একটু বেশি রাগী।  একটু এলোমেলো।  'Norwegian Wood' বইটা  বেশ লাগছে পড়তে এই সন্ধ্যেতে।  ফোনের আওয়াজে  ছন্দ কাটলো। ঋষি ফোন করছে।

 

"তিথি  কি করছো ? ঘরেই আছো তো !" ঊফ, আবার নিকনেম ধরে ডাকা শুরু করেছে।  কিছুদিন আগে হয়েছে 'তুই' থেকে 'তুমি' ।  আর পারা যায় না। 

 

"হ্যাঁ ঘরেই, এই চা খাবো এবার । তুই ?" - সুদীপ্তা বিরক্তি ঢাকার চেষ্টা করে।

মায়ের অনুরোধে কি  এই  সম্পর্কটা এগোনো ঠিক হচ্ছে  , দোলাচলে পড়েছে  সে।

 

"এই বেরোলাম, একটু জগিংয়ে  । তারপর একটু ডিটক্স  ড্রিঙ্কস খেয়ে ফিরবো। তোমাকে তো কত করে বল্লাম , ২ উইক এর জন্যে ঘুরে যাও...

 

বরুন বলতো বৃষ্টি হোক, কিন্তু  যখন রাতে ঘুমাবে তখন । ও নাকি বৃষ্টির রিমোট বানানোর স্টার্টআপ খুলবে।  কিছু বাজে বকতে পারে ছেলেটা।  কে জানে ও কোথায় ? কলকাতাতেই আছে তো? কি করে কে জানে, এখন ?

 

"কি গো।.. ..তিথি ??" সুদীপ্তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। 

বেশিক্ষন কথা হয়না, কাটিয়ে দেয়, এটা সেটা বলে। 

 

"তিথিদি তোমার চা" - বিমলাদি এসেছে ব্যালকনিতে।

 

চা হাতে নিয়ে , সেই ঝুপড়ির  কথা মনে পরে গেল সুদীপ্তার ।  শেষ দিন কাকার দোকানে সেই ৬ মাস এর ডিল। ঠিকই তো চলছিল। বরুনের সঙ্গ খুব ভালো লাগতো ওর। সময় কোনো নিষেধ মানত না।

 

কিন্তু এটাও ঠিক, আর বেশিদিন চলতো না সেভাবে ।  একটা অচেনা ধাক্কার দরকার ছিল।  

 

মা ঋষির সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে-পরে লেগেছিলো। কি করেই বা না করি , ছোটবেলা থেকে জানাশুনা।  বাবা আর কাকু ঠিকই করে রেখেছিলো প্রায় একরকম।  যদিও আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনীটা প্রায় একইরকম, সোশ্যাল স্টেটাসটাও ।  কিন্তু  ঋষির আর আমার জীবনটাকে দেখার ভঙ্গিটা আলাদা।  ও চায় বাইরে সেটল করতে , ৭টা মহাদেশ ঘুরতে , দারুন একটা ক্যারিয়ার আর আমি যেন ওর সাথে থাকি। শুধু ওর সাথে  থাকি !!!

 

আমার যে এতকিছু চাই না, আমার যে তিলোত্তমা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, আমার যে এই ভিড়, এই হৈচৈ ,এই রাস্তার বাঁকে বাঁকে গল্পগুলো ভালো লাগে।  আমাদের বুটিকে পুরুলিয়ার এক দিদির হাতের কাজ থাকুক, আর তার সাথে থাকুক আমার একটু হাতের কলকা।  ২ জনের চাওয়ার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক।

 

আর তারমধ্যেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বরুনটা।  যেন সারাদিনের গরমের পর হঠাৎ ১০ মিনিটের বৃষ্টি, আর তার সাথে মাটির সোঁদা গন্ধ। কি সহজভাবে জীবনটা দেখতে পারে ছেলেটা।

 

বরুনের সঙ্গে অন্য এক জীবনের স্বপ্ন মুছে ফেলা ক্রমশঃ অসম্ভব হয়ে উঠছিল।  কাকার দোকানে বসে বরুনকে বলতে বাধ্য হয়েছিল সে - অন্যের কোমর ঠিক করার সাথে সাথে , আমাদের নিয়ে একটু ভাবুন Mr বরুন।

 

চ্যালেঞ্জ  একসেপ্ট করেছিল ছেলেটা।   "ঠিক আছে ম্যাডাম , একটা চুক্তি করা যাক।  ৬ টা মাস , আমায় সময় দাও।  আমি দেখি তোমার সাথে বিয়ে করার মোটিভেশন আমায় দিয়ে কি কি করাতে পারে?  এই ৬ টা মাস , তুমিও ভাবো কি চাও জীবন থেকে তুমি।  আর চুক্তির লাস্ট পয়েন্ট।  কেউ কারুর সাথে যোগাযোগ রাখবো না এই কয়েক মাস।   বলো রাজি ?"

 

রাজি হয়ে গেছিলো সুদীপ্তা।  কথা দিয়েছিলো ঋষি আর তার গুষ্ঠিকে ৬ মাস আটকে রাখবে সে। 

 

বরুন কি সত্যি কিছু একটা করতে পারবে এই ৬ মাসে? পারবে আরেকটু সিরিয়াস হতে ? সিরিয়াস হলে কি আমারই বা ভালো লাগবে, না ওর ? আমাদের সম্পর্কটা কি পরিণতি পাবে , না প্যারিস-টাই আমার ডেস্টিনি  ?

 

ধুর !! এত গুলো দিন দেখি না , কথা বলিনা।  সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম মনে হচ্ছে। মনটা ভারী হয়ে এলো।

 

গিটারের দিকে হাত বাড়ায় সে। 

 

"...

রোজ রোজ কত কত হাজার হাজার ভয়

মনে যখন ভিড় করেছে

ঘরের কোণে আপন মনে

সেই ভয়গুলো কাটিয়ে দিয়েছে..."

 

 

মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।  ৬ মাস ১দিন।

 

রাতে ঘুমাতে পারেনি ছেলে , শুধু ভেবেছে 'টার্টে -টার্টিন' না 'মিষ্টি দই '।

সকাল সকাল  মোটরসাইকেল  হাঁকিয়ে খোকার দোকানে। প্রজাপতি বিস্কুট আর লাল চা। 

 

সুদীপ্তা আজ বেরোয়নি ঘর থেকে। মা গাছে বুটিকে । 

ফোনটা হাতে। হৃৎপিণ্ডের উপস্থিতি স্পষ্ট। 

কই, আসছে না তো !  নিজেই ফোন করবে নাকি ?

 

ফোন বেজেছে এবার। ও বাবা , অচেনা নম্বর তো।  ধুর, ধরলো না সে। 

৩ বার আসলো । শেষে ধরেই ফেললো, হয়তো বুটিকের কাস্টমার। 

 

"বলছি আমার থাইরয়েড টেস্ট এর জন্যে ব্লাড স্যাম্পলটা নিতে তো আর আসলেন না।  আর কত ক্ষণ না খেয়ে থাকবো দিদিভাই  " - ফোন-এ পুরুষ কণ্ঠস্বর।

 

শেষে রঙ  নম্বর।  কি একটা বলতে যাচ্ছিলো সুদীপ্তা , হঠাৎ মনে পরে গেল, সেই ১ বছর আগের ঘটনাটি । "বরুন ? "

 

সেই প্রাণখোলা  হাসি।  সুদীপ্তা বুঝতে পারে।

কথা হলো , বিকেলে সেই কাকার দোকানে দেখা  করবে তারা।

 

 

বিকেল ৫টা।  কাকার দোকানে বরুন আর সুদীপ্তা সামনা সামনি।  ৬ মাস কেটে গেছে।  কেউ কোনো কথা বলে না। ব্যাস্ত গলিতেও যেন নিস্তব্ধতা।

 

সুদীপ্তাই প্রথমে বলে "কি ব্যাপার বরুণেশ্বর  বাবা, এত শান্ত যে? হিমালয়ে  ধ্যান না সুন্দরবনে তান্ত্রিক যোগসাধনা করলেন গত  ৬ মাস।  দাড়িটাও কিন্তু মানানসই " 

 

বরুন হাসে অল্প।

 

বরুনের হাত ছোঁয় সুদীপ্তার হাত  । সেই ভুলতে বসা অনুভূতিটা ।  ধমনীতে ট্রাফিক বেড়ে গেল ।  ২ ফোঁটা পড়লো মনে হয় ।

 

"বলুন কিছু " - সুদীপ্তা সামলে নিয়ে রসিকতা চালিয়ে যেতে  চায় , আড়াল  থাকে অনেক কিছু।

 

"ওরে মেয়ে , বাবার সাথে মস্করা করিস নে।  আমার রোষে সরকার অব্দি বদলে যায়, আর তুই কোথাকার তন্বী  । " - বরুনও সঙ্গ দেয় ।


সুদীপ্তা হাসে , একটু নিশ্চিন্ত হয়।

 

তারপর হঠাৎ 

" সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পার

মাকে বলে দাও বিয়ে তুমি করছ না..."

- বরুনের অমায়িক গলায় অঞ্জনদা।

 

ঝুপড়ির সব কটা চোখ তাদের দিকে।  বরুনের তাপউত্তাপ নেই ,সুদীপ্তা মুখ লোকায়।

 

বরুন শুরু করে -


"শোন্, তুই কিন্তু এখন BD TATA & Sons কলেজ & হসপিটালের ফিজিওথেরাপি ডিপার্টমেন্ট এর অ্যাসিস্ট্যান্ট HOD এর সাথে কথা বলছিস। মাস্টার্স শুরু ৭ মাসে, ঐখানেই ।  ওরাই সব হেল্প করবে।


আমি জানি না , তুই কি এক্সপেক্ট করেছিলি।  ভেবেছিলি হয়তো আমি CAT এর জন্যে প্রিপেয়ার করছি, তাই না  ? বা হয়তো ভেবেছিলি এর দ্বারা কিসসু হবে না। 

"আমার লোকজনকে হেল্প করতে পারলে, খুব স্যাটিসফায়েড লাগে রে । তাদের মুখের হাসিটাই আমার প্রাপ্তি।


যাই হোক , এই হলো ব্যাপার , বুঝলি ? এবার বলুন ম্যাডাম , দেবে তোমার মালাখানি , বাউল এই মনটাকে ?" - এক নিশ্বাসে কথা শেষ করে , সুদীপ্তার দিকে তাকায় সে। 

 

এইবার চোখ ভেজার পালা সুদীপ্তার।  ছেলে সত্যি সত্যি করে দেখালো।  আর যেটা ওর ভালো লাগে সেই ফিল্ড-এ। ৬ মাস খুব একটা লম্বা সময় নয় , কিন্তু ও পেরেছে । খুব গর্ব হচ্ছে ওর। 

 

"কি হে তনয়া , বলো কিছু " - বরুন পরীক্ষার ফল জানতে উৎসুক ।

 

 সুদীপ্তা জড়িয়ে ধরে বরুণকে।  কিছু বলতে পারে না সে।  বলার দরকারও সেরকম ছিল না হয়তো।

 

********** 

 

সম্পাদকের সংযোজন :- নিরুপম ও অঞ্জনার ছকভাঙা গল্পটির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের শারদীয়া শুঁয়োপোকা (https://anyflip.com/ygujr/jcov) পত্রিকায়। এই গল্পটি তারই দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব।

9 views
bottom of page