পা পি য়া চ্যা টা র্জি
ভারত
গড়ের মাঠে বসে চিনে বাদাম খেতে খেতে মাঝে মাঝেই ঘড়ির দিকে তাকায় তুয়া।মনে মনে বিড়বিড় করে আর বলে – ‘এসো আজ তোমার হচ্ছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বলে এখন সোয়া ছ'টা। পঁয়তাল্লিশ মিনিট, এভাবে একা একা এখানে বসে থাকা যায়। কোনোদিন যদি রাইট টাইম এ আসে। আবার হবু ডাক্তার। কোনো টাইম জ্ঞান নেই। কি করে ডাক্তারি করবে কে জানে?’ বলতে বলতে জিভে কটাং করে এক কামড়।
‘ওমাগো, গেল জিভটা’ - বলে লাফিয়ে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে ব্লু কালারের ডেনিমের জ্যাকেট গায়ে বাইকে চড়ে আসছে তার হিরো আকাশ। বাইকটা চালিয়ে সোজা ওর পায়ের কাছে এনে থামায়।
‘উফ এখনই লেগে যেত’।
নিজের দুকান ধরে বলে ‘সরি ডার্লিং একটু দেরি হয়ে গেল।‘
‘একটু ? একটু? পাক্কা ৪৫ মিনিট।'
রাগে নাক লাল হয়ে গেছে তুয়ার। তুয়া আর আকাশের প্রেম গত চার বছর ধরে। তুয়া ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স করছে, আর আকাশ এমবিবিএস কমপ্লিট করে এমডি হওয়ার জন্য এক্সাম দিয়েছিল। আজ রেজাল্ট আউট হয়েছে, খুব খুশি আকাশ আজ। রান্ক ভালই হয়েছে। বাইক থেকে নেমে ‘বসো বসো’ বলে বসে পড়ে ।
‘আরে বসে বসেই তো ৪৫ মিনিট কেটে গেল এর মধ্যে কতজন এখানে এলো গেল তোমার কোন খেয়াল আছে?’
‘আর একটু দেরী হয়ে গেল। এত রাগ করে নাকি?’
‘ সেই চার বছর ধরে তোমার শুধু একটুই দেরি হয়ে যায় বলেই কেটে গেল।‘
‘ নাও নাও বসো’-বলে টেনে হাত ধরে বসিয়ে দেয় তুয়াকে।
‘সব সময় এত রাগ করো কেন তুমি! দেখো দেখো নাকের ডগাটা সব সময় লাল ‘-বলে নাকটা টিপে দেয়।
“‘ছাড়ো’- বলে হাতটা সরিয়ে দেয় তুয়া।
‘তুমি কোনদিনও বদলাবে না। এখানে জানো কতগুলো কাপল এলো, কত গল্প করল আর তুমি আসতে আসতে এত লেট করলে আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেল‘
‘ তাই? ওরা কি কি করছিল তুমি বসে বসে দেখছিলে? ওরা তো গল্প করার সাথে আরো কত কি করে। তুমি করো?‘
‘কি করে ?’
‘দেখো দেখো, ওই ইয়োলো শার্ট আর ব্লু সালোয়ারের ওই কাপলটাকে দেখো! আহারে, ছেলেটা কি সুন্দর মেয়েটার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর মেয়েটা ওর চুলগুলো কি সুন্দর ভাবে হাত বোলাচ্ছে।‘ ‘অসভ্যগুলো। ওরা অসভ্য।‘
‘হ্যাঁ সবাই অসভ্য।আর তুমি যত... যত্তোসব। তুমি কিছু জানো না। আমার সাথে ঝগড়া করা ছাড়া তোমার আর কিছু আসে না। কোনদিন ওই ভাবে আমাকে কাছে ডেকে সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়েছো কোনদিন একটাও আদর করে চুমু দিয়েছো?’
‘ আহারে, বেয়াল্লাপনার একটা সীমা আছে।‘
‘হ্যাঁ তাইতো! সবাই বেয়াল্লাপনা করে। প্রেমে একটু আধটু ওরকম হয়। শুধু তোমারই হয় না একটু কোন ইয়ে নেই, একদম বেরসিক যাকে বলে।‘
‘দেখো আমাকে রাগাবে না বলে দিচ্ছি। গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি তোমার গালে আমি চুমু দিইনি?’
‘হ্যাঁ দিয়েছো। সে তো ভিখারিকে ভিক্ষা দেয়ার মত সেটা নেওয়ার জন্য তো আধঘন্টা ধরে কাকুতি মিনতি করতে হয়েছিল।‘
‘চুপ করো তো শুধু আলতু ফালতু কথা’
‘আলতু ফালতু নয়, আমার তো এখন থেকেই চিন্তা লাগে চার বছরেও যার এইটুকু রোমান্স করার ইচ্ছা জাগেনি বিয়ের পর সে কি করবে। দাঁড়াও আমাদের বিয়েটা আগে হতে দাও তারপর...’
‘তারপর কি? বলো বলো। তাছাড়া তোমাকে বিয়ে করব আমি? পাগল নাকি!’
‘তাছাড়া তোমাকে কে বিয়ে করবে? কেউ করবে না। ওই সারাক্ষণ নাকের ডগা লাল। সবসময় ঝগড়া যার মাথার মধ্যে ঘুরছে তাকে কেউ বিয়ে করে না। এ হতভাগা ছাড়া তোমার বিয়েই হবে না।‘
‘ও আমি শুধু তোমার সাথে ঝগড়াই করি, কোথা থেকে আমার রাজপুত্র এলেন রে, তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি মরে যাইনি। বুঝলে?’-বলে ওখান থেকে উঠে যায় তুয়া।
‘চললাম আমি খুজে নিও তোমার অন্য কাউকে যে তোমাকে আদর করবে, চুলে হাত বুলিয়ে দেবে, চুমু দেবে ‘-বলতে বলতে গট গট করে রেগে চলে যায় তুয়া।
আকাশ ছুটতে থাকে ওর পিছু পিছু। হাতটা ধরে জোর করে চেপে ধরে –'প্লিজ তুয়া, যেও না এইতো এলাম একটু বসো এই দেখো কান ধরছি। প্লিজ প্লিজ যেও না। এই তো এলাম একটু বোসো, দেখো একটা কথা বলার আছে’।‘
হাতটা ঝাঁকিয়ে সরিয়ে নেয় তুয়া। ‘বয়ে গেছে আমার তোমার কথা শুনতে’ বলতে বলতে চলে যায়।
আকাশ চিৎকার করে ‘ঠিক করছো না,শোনো’।
তুয়া এগিয়ে চলে।
‘সত্যি কিন্তু আমি অন্য কাউকে খুঁজে নেব।‘
তুয়া কান দেয় না এগিয়ে চলে। আকাশ মাথায় হাত দিয়ে গড়ের খোলা মাঠে বসে পড়ে। এমনি করেই তুয়া আর আকাশের প্রেম চলছে গত চার বছর। ঝগড়া আবার ভাব, ঝগড়া আবার ভাব। প্রেমে ঝগড়াটা ওদের এত বেশি বোধ হয় ওটাই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ঝগড়া করে তুয়া বাড়ি ফিরে যায়। হাত পা ধুয়ে কিছু খাবার খেয়ে কেমিস্ট্রির ইনঅর্গানিক বইটা নিয়ে বসে। বসে বসে ভাবে ‘এইরে চলে তো এলাম কি যেন একটা বলবো বলছিল শোনা হলো না । ধুত,একটু পরেই ফোন করবে। আমার সাথে রাগ করেও বেশিক্ষণ থাকতেই পারে না।‘ বইটা নিয়ে পড়তে বসে। কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারে না কেবলই চোখটা চলে যায় ফোনের দিকে। এই বোধহয় আকাশ মেসেজ করলো কত রকম ফোনে মেসেজ ঢোকে তখনো টুং টুং কখনো ক্রিং ক্রিং শব্দ করে। কিন্তু কই আকাশের তো একটাও এখনো মেসেজ ঢুকলো না যাক রাতে ফোন তো নিশ্চয়ই করবে ভাবতে ভাবতে খাতায় কত রকম আঁকিবুকি কেটে চলে আর মাঝে মাঝে ফোনটার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়। এই বুঝি আকাশের রিংটা বাজলো।
নটা বাজলে মা খাবার জন্য ডাকে। নটার মধ্যেই খেয়ে নেওয়ার অভ্যাস বাড়ির সকলের। তুয়া খেয়েদেয়ে এসে শুয়ে পড়ে। ১১ টা না বাজলে আকাশ ফোন করবে না প্রতিদিন ওই সময়ে তুয়ার সাথে কথা না বললে আকাশের নাকি ঘুম আসেনা। ফোনটাই ওদের দুটো ঠোঁটকে কাছে আনার কাজ করে। শোবার আগে ফোনে একটা করে চুমু না নিলে আকাশের নাকি ঘুম আসে না। অবশ্য আকাশের এই শর্তটা মানানোর জন্য আকাশকেও কম মানাতে হয়নি তুয়াকে। অনেক কষ্টে রাজি হয় তুয়া। অবশ্য ওই একটা শর্ত তুয়ারও ভালো লাগে, না হলে যেন কিছু একটা হয় মনে। এগারোটা বাজতে এখনো অনেক দেরি ঘড়ির কাঁটার সময় যেন পেরোতেই চাইছে না। আসার পর থেকে একটা মেসেজও করেনি আকাশ। সত্যি কি রাগ করলো নাকি? আকাশ পাতাল অনেক কিছুই ভাবতে থাকে। হাতে ফোনটা নিয়ে শুয়ে থাকে তুয়া। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিছুই ঘাঁটতে মন চায় না। এলোমেলো কত কিছু দেখে চলে ফোনে, কিন্তু আকাশের ফোন আর আসে না। এরপর সত্যিই তুয়া বিচলিত হয়ে ওঠে। এরকম তো কোনদিন হয় না, সত্যিই কি রাগ হলো নাকি? কিন্তু এরকম ঝগড়া তো ওদের প্রায়ই হয়। তবে? মনটা ভীষণ আনচান করে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে রিং করে ফেলে আকাশকে। ওপার থেকে ভেসে আসে... the number you have called is currently switched off.
Swiched off? আশ্চর্য হয়ে যায় তুয়া। ব্যাটারিতে চার্জ নেই নাকি? না ইচ্ছে করে সুইচ অফ করে রেখেছে। আবার ডায়াল করে বার দশেক। ওপার থেকে সেই একই ধ্বনি বেজে ওঠে সুইচ অফ। কিন্তু হঠাৎ সুইচ অফ কেন? সত্যিই কি আকাশ আজ হঠাৎ ভীষণ রেগে গেছে? কিন্তু তুয়ার তো আজ ঘুম আসবে না, আর আকাশ? ওই বা ঘুমোবে কি করে? ও তো তুয়ার চুমু না নিয়ে ঘুমায় না। ঝগড়াটা কি আজ বেশি হয়ে গেল নাকি? নানা রকম ভাবতে থাকে তুয়া। ফোনটা বুকে নিয়ে একবার এপাস একবার ওপাস করতে থাকে। মনে মনে অভিমানও হয় খুব ‘আহারে। নিজে সব সময় দেরি করে আসবে আর কিছু বললেই আমার দোষ’ তবুও মনে মনে ভীষণ কষ্ট লাগে।
কি যেন একটা বলবেও বলেছিল সেটাও তো আর শুনলো না। তবে কি তাই রাগ হয়েছে? অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ‘সরি’ বলে একটা মেসেজ লিখে দেয় তুয়া, তার সঙ্গে গোটা কয়েক চুমুর সাইন। তারপর অনেকক্ষণ ডানাকাটা পাখির মত ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে তুয়া। সকালে পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙ্গে। চোখ মেলেই ফোনটার দিকে নজর যায়। ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেখে। না কোন মিসড কল, না মেসেজের উত্তর। ফোনটা আর একবার ডায়াল করে। এরপর সত্যি সত্যি তুয়ার মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়, সাথে চিন্তা ও। কিছু হলো না তো আকাশের? শরীর ঠিক আছে তো? এরকম তো কোনদিন হয়নি। সমস্ত প্রাতক্রিয়া সেরে তুয়া ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। সকালের শান্ত স্নিগ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের আকাশকে ভাবতে থাকে তুয়া। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। ওদিক থেকে কোন রেসপন্স আসে না তুয়ার। এবার ভীষণ চিন্তিত হয়ে ওঠে আকাশের জন্য। তখন সকাল ১১টা তুয়া আবার কল করে।
ওপারে রিং বেজে ওঠে ‘হ্যালো’
‘কি ব্যাপার? কি হয়েছিল তোমার? সারারাত ফোন সুইচ অফ চিন্তা হয় না বুঝি আমার?’ কথাগুলো একনাগারে বলে চলে তুয়া।
‘এখন রাখো আমি ব্যস্ত আছি,’ বলে আকাশ ফোনটা কেটে দেয়।
এরপর তুয়ার মনে ক্রমশ অভিমান পেঁজা তুলোর ন্যায় ঘনীভূত হয় তার সাথে খুব রাগ হয় আকাশের ওপর। সারারাত তুয়া নানা টেনশন সময় কাটিয়েছে অথচ ওর কথা শুনে আকাশের কোন দুঃখ আছে বলেও মনে হলো না তুয়ার। তুয়া রাগে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে অন্য কাজে চলে যায়।
এদিকে আজ সকালেই তুয়ার বাবা প্রাতরাশ খেতে খেতে তুয়ার মাকে বলে –'তুয়ার এবারে বিয়ের ব্যাপারে ভাবতে হয় বুঝলে? গতকাল সল্টলেকের সুমন্তদার সাথে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় একটি ভালো পাত্রের সন্ধান দেয়। ছেলেটির কম বয়স দেখতে শুনতে মন্দ নয় আবার ডাক্তার, তুয়াকে একবার জিজ্ঞেস করো না যদি মত থাকে তবে মন্দ কি? এরকম পাত্র পাওয়া যাবে না।‘
মা বলে,-‘ তুয়াকে ওদের পছন্দ হবে?’
‘কেন হবে না? আমাদের তুয়া মা কম কিসে? রূপে গুনে ঘাটতি আছে কিছু?’
‘সেই তোমার যা মেয়ে! সব সময় নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরছে। কথায় কথায় রেগে যায়। আদর দিয়ে দিয়ে তো একেবারে বিগড়ে দিয়েছো দেখো বিয়ের পর ওর বর ওকে রাখলে হয়!’
‘কি যা তা বলছো? তুমি না? তা তোমার মেয়ে তো তোমার মতই হয়েছে ।যেমন মা তেমন তার মেয়ে। এমন একটা দিন আছে যেদিন তুমি আমার সাথে ঝগড়া না করে থাকো? তা তোমার থেকে তো ভালো সে। তোমাকে যখন এত বছর নিয়ে ঘর করছি তখন সেও পারবে। তুমি শুধু ওকে জিজ্ঞেস করো।‘
‘পারবো না ।তোমার মেয়ে তুমি জিজ্ঞেস করো গে।‘-বলে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায়।
ওদিকে তুয়ার সমস্যা বাড়তেই থাকে। এক সপ্তাহ্ হতে চলল না ওদের দেখা হয়েছে না ভালো করে কথা। তুয়া এবার মনে মনে খুব কষ্ট পায়। কোন কাজে মন বসাতে পারে না মাঝে মাঝে ফাঁক পেলেই আকাশের কথা মনে পড়ে কান্না পায়। একদিন আকাশ নিজে থেকে ফোনও করেনি। তুয়াই করেছে কিন্তু ভালো করে রেসপন্স পায়নি। তুয়া মনে মনে অনেক কিছু কল্পনা করে। মনে হয় সত্যিই আকাশ কি ওকে ভুলে গেল? ও সত্যিই অন্য কোন মেয়েকে...না আর ভাবতে পারে না। হঠাৎ কি মনে করে রেডি হয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তুয়া। গলির মোড়টা পেরিয়ে গড়িয়াহাটের যেখানে বিখ্যাত জগন্নাথের মিষ্টির দোকানটা ঠিক তার উল্টো দিকের দোকানটায় কিছু খুঁটিনাটি জিনিস কেনার জন্য বেরিয়ে যায়। আর কুড়ি দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর তুয়া ও নিজের হাতে তৈরি করা গিফট আকাশকে দেয়। আকাশ খুব খুশি হয়। এবারও ওকে একটা দারুন গিফট দিয়ে চমকে দেবে বলে তুয়া ভাবল। যতই রাগ করে থাকুক না ওই দিনটাই আকাশ নিশ্চয়ই আসবে। জিনিসগুলো কেনাকাটা করে যখন দাঁড়িয়ে আছে সামনে থেকে একটা বাইক সজোরে হুশ করে ওর সামনে দিয়ে পেরিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তুয়া তাকিয়ে দেখে ‘আকাশ না ? পেছনে একটা মেয়েও রয়েছে। কে ওটা?’
সঙ্গে সঙ্গে তুয়ার ভেতরটা আনচান করে ওঠে তবে কি সত্যিই আকাশ অন্য কারো প্রেমে পড়েছে? সেদিন বলেছিল অন্য কাউকে খুঁজে নেবে তবে কি সত্যিই অন্য কাউকে... না আর ভাবতে পারে না তুয়া। দুচোখ জলে ভরে ওঠে। আকাশ মেয়েটিকে পিছনে বসিয়ে বাইকে নিয়ে চলে যায়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে কেনা জিনিসগুলো দূরে ছুড়ে ফেলে বালিশে মুখটা গুঁজে অঝোরে কাঁদতে থাকে তুয়া। রাগে অভিমানে হৃদয় ফেটে যায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ সব লাল হয়ে ওঠে।
এদিকে অত ভালো একটা পাত্র হাত ছাড়াও করতে চায় না তুয়ার বাবা। তুয়াকে ডেকে ওর বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওর বিয়ের সম্বন্ধের কথাটা পারে। তুয়া চুপচাপ শুনে যায় কোন উত্তর দেয় না। পাত্রের ছবিটা একবার দেখানোর চেষ্টা করে তাও দেখে না। তুয়ার এরকম মন মরা ভাবটা কদিন ধরেই ওর বাবা-মা লক্ষ্য করে।
বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করে-‘কি হয়েছে বলোতো তুয়ার?’
‘কি জানি কদিন ধরেই তো এরকম দেখছি ‘
‘প্রেমে পড়েনি তো তোমার মেয়ে ?’
‘কি জানি কোন কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর তো দেয় না।‘
তুয়ার মাকে ওর বাবা বলে, ‘দেখো মায়া এই পাত্র টি খুবই ভালো। তুয়ারোতো বিয়ের বয়স হয়েছে। যদি কিছু হয়ও তো ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করো। আমি আমার মেয়ের একটি ছবি সন্তুদার হাতে ওদের কাছে পাঠিয়েছিলাম, তুয়ার সব বায়োডাটা শুনে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে।
এদিকে সত্যিই আকাশ তুয়া কে এভোয়েড করতে থাকে। ফোন যদিও বা তোলে ভালো করে উত্তর দেয় না। তুয়ার হৃদয়ে যেন কেউ একটা বিরাট পাথর চাপিয়ে দেয়। অভিমানে দুঃখের যন্ত্রণায় তুয়ার হৃদয় ফালা ফালা হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে যায়, সে মনে মনে উপলব্ধি করে আকাশ ছাড়া তার অস্তিত্বই নেই। সে যে আকাশ কে কত ভালবাসে আজ সে নিজেই বুঝতে পারে। কিন্তু ছোট থেকেই তুয়া বড় অভিমানী, হারতে কারোর কাছে শেখেনি। মনে মনে ঠিক করে ‘তুমি যদি আমায় ছাড়া থাকতে পারো তবে আমিও কেন নই?’ গঙ্গার ধারে বসে বসে এরকম অনেক কিছুই ভাবতে থাকে। তারপর বাড়ি ফিরে আসে।
রাতে ডিনারের সময় ওর মা বাবা আবার তার বিয়ের কথাটা পারে। আকাশের মুখটা ওর চোখে সামনে ভেসে ওঠে। সমস্ত অভিমানকে বুকে চেপে তুয়া ওর বিয়েতে সম্মতি দেয়। ওর মা বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। পাত্রের বাড়িতে খবর পৌঁছে দেয় তারাও রাজি হয় পাত্র-পাত্রী কেউ কাউকে দেখে না। মা বাবার কথাতেই সমস্ত কিছু রাতারাতি ঠিক হয়ে যায়। যথারীতি বিয়ের দিনও ধার্য হয় আঠাশে ফাল্গুন।
বিয়েতে সম্মতি দিলেও তুয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আকাশ কি করে ওকে ভুলতে পারে? কিভাবে ওকে ঠকাতে পারে? দু বাড়িতেই বিয়ে তোড়জোর চলতে থাকে শাড়ি গয়নাগাটি কেনা। কিন্তু তুয়ার আর কোন কিছুতেই ইন্টারেস্ট নেই। যথারীতি বিয়ের দিন এসে হাজির। সকাল থেকে তুয়া দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদে চলে। আজ ২৮ শে ফাল্গুন আর ১৪ ফেব্রুয়ারি, এই দিনটার জন্য আকাশের সাথে কত পরিকল্পনা করেছিল আকাশ বলেছিল তোমাকে এবছর একটা স্পেশাল গিফট দেব দেখো। ভেবে তুয়া আরো কাঁদতে থাকে। সম্মতি দিলেও এই বিয়েতে মন লাগাতে পারছেনা তুয়া। শরীরটাকে বিছানা ছেড়ে তুলতে ইচ্ছে করছে না । মনে পড়ছে শুধু আকাশকে। যদি আজও আকাশ এ সে বলত—'চল পালাই তুয়া’, তুয়া সব ছেড়ে আকাশের সাথে সাথে পাখির মতন উড়ে চলে যেত।
সবাই দরজায় কড়া নাড়ছে, ‘খোল তুয়া তোর গায়ে হলুদ, চল সাজিয়ে দিই ‘। ঘর ভর্তি লোক তুয়ার। সকাল থেকে বিয়ের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সম্পূর্ণ হল। বিকেল হয়ে এসেছে তুয়াকে সবাই বিয়ের কনে সাজাতে ব্যস্ত। লাল চেলি গয়না মুকুটে রানীর মত লাগছে। নিজের মুখটা আয়নায় দেখতে ইচ্ছে করছিল না তুয়ার। হঠাৎ সবাই ছুটাছুটি শুরু করে। বাইরে শঙ্খ ধ্বনি উলুধ্বনি বেজে ওঠে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে তুয়া। বিয়ে শুরু হয়। তুয়ার শুভ দৃষ্টির জন্য ডাক পড়ে। সব মামাতো দাদারা পিঁড়ি বসিয়ে ওকে বরের কাছে এনে হাজির করে। তুয়া চোখ বন্ধ করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে থাকে, ‘ঠাকুর একবার আকাশকে পাঠিয়ে দাও। একবার শেষ দেখা দেখতে চাই।‘
নাপিত বলে কই এবার বর -বউ একে অপরের দিকে তাকাও। তুয়া কিছুতেই তাকাতে পারে না। অতি কষ্টে একবার তাকিয়েই পলক ফেলে দেয়। ক্ষণিক এই বুকে শিহরণ ছুটে যায়। মনে হয় ‘আকাশের মতন দেখতে না?’ কৌতুহলে আবার তাকায় তুয়া। অত্যন্ত আশ্চর্যে তুয়া সামনের বর কে দেখে। এত আকাশ! কি ঘটছে কিছুই খুঁজে পায় না। অপরপক্ষ তখন দু কান ধরে অবিরাম হেসে চলেছে। তুয়ার বুকে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে। আনন্দে ধারা দুই চোখ দিয়ে ঝরতে শুরু করে। ‘শয়তান আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব মজা পাওয়া না?’
পাশে তাকিয়ে দেখে সেই দিনের ওই বাইকের পেছনে বসা সেই মেয়েটা।
অবাক হয়ে যায় ‘ ও কে ?’
‘টিনা’- ছোট মাসির মেয়ে।
দূরে দাঁড়িয়ে টিনা মুচকি হাসে।
নাপিত বলে, ‘এত কথা পরে হবে আগে মালা বদল হোক’
মালা বদল হতে হতে আকাশ বলে, ‘তোমায় বলেছিলামনা এবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি তোমাকে একটা স্পেশাল গিফট দেবো?’
আনন্দের কান্না ঝরানো গলায় বলে ‘স্পেশাল নয়, জীবনের বেস্ট গিফট’।
মালা বদল সমাপ্ত হয়। দূরে বিয়ের সানাই বেজে চলে—‘আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো।‘